‘১৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা আজাদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজাদ আর ফিরে আসেনি। এটা শহরের অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধারই জানা যে, এই ১৪টা বছর আজাদের মা একটা দানা ভাতও মুখে দেননি, কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন; কারণ তাঁর একমাত্র ছেলে আজাদ তাঁর কাছে ১৪ বছর আগে একদিন ভাত খেতে চেয়েছিল; পরদিন তিনি ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন রমনা থানায়, কিন্তু ছেলের দেখা আর পাননি। তিনি অপেক্ষা করছেন ১৪টা বছর, ছেলের আগমনের আশায় পথের দিকে চেয়ে থেকে। অপেক্ষার এই ১৪টা বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি, শানের মেঝেতে শুয়েছেন, কী শীত কী গ্রীষ্ম, তাঁর ছিল একটাই পাষাণশয্যা, কারণ তাঁর ছেলে আজাদ শোয়ার জন্য রমনা কি তেজগাঁ থানায়, কি তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি।’
এমনই বিষয় ছিলো ‘মা’ উপন্যাসের। মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাসটি লিখেছেন আনিসুল হক। যাকে নিয়ে এ উপন্যাস সেই আজাদের জন্য তাঁর মা সাফিয়া বেগম ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। শহরের গেরিলা যোদ্ধা আজাদের খুব কাছের বন্ধু ছিলো শহীদ রুমী। ছেলের অপেক্ষায় যখন বছরের পর বছরের অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন আর এ সময়কালীন চারদিক থেকে ক্রমশ নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছিলেন আজাদের মা। ১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আজাদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, পৈশাচিকতাকে যারা মেনে নিতে পারেননি তাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই জন্ম নেয়া আজাদ। আজাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার মগবাজারে ২০৮ নিউ ইস্কাটনের বাসায় ছিলো। বলা হয় সে সময়ে সেটিই ছিলো শহরের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বাসা।
সব কিছুর উর্দ্ধে যখন দেশকে স্বাধীন করার বিষয়টি সামনে এসে পড়লো তখন আজাদসহ একদল তরুন যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। এ তরুনের দল মেনে নিতে পারেনি পাকিস্থানিদের হিংস্রতা। আর তাই যুদ্ধে যাওয়ার পরেও আজাদ তার মাকে একাধিকবার বলেছিল, ‘মা আমি কিন্তু রাজনীতি করি না, পলিটিক্স করতে আমি যুদ্ধে যাই নাই, আমি যুদ্ধে গেছি বাঙালির উপরে পাকিস্থানিদের অত্যাচার মানতে পারছি না বলে, রাজার বাগের পুলিশ ব্যারাকে ওরা যা করছে..।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা আক্রমণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। বাংলার দুরন্ত এবং দু:সাহসি গেরিলারা নানা কায়দায় আক্রমনের মাধ্যমে পাকিস্তানিদের মূর্হমুর্হ তটস্থ করে রাখতো। এমনই এক গেরিলা দলের সদস্য ছিলো আজাদ। গেরিলাদের আক্রমনের বিষয়ে ক্যাপ্টেন হায়দার বলেছিলেন ‘গেরিলারা কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করবে না, তারা হঠাৎ আক্রমণ করবে, লুকিয়ে যাবে জনারণ্যে। এমন রণকৌশলে কাজ করেছেন দু:সাহসি গেরিলারা।’
এমন সব ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা ‘মা’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যন্য এক দলিল। সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চাইলে বাধা দেয়ার বিষয়টিও ভাবতেন না জন্মদাতা মা, বাবা কিংবা পরিবারের সদস্যরা। মন খারাপ নয় বরং সাহস দিতেন আর বলতেন, দেশকে স্বাধীন করেই তবে ফিরবি। আমেরিকান ইলিনয় ইনস্টিটিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মা জাহানারা ইমামকে নিজের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান রুমী। কি বলবেন এই ভেবে কিছুটা বিচলিত জাহানার ইমাম শেষ পর্যন্ত না করতে পারেননি। বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন রুমীর যুক্তিতে হেরে গিয়ে শেষে অনুমতি দিয়ে বলেন, ‘যা, তোকে দেশের জন্য কুরবানি করে দিলাম। যা তুই যুদ্ধে যা।’ দেশকে স্বাধীন করতেই এমন ছিলো মা’দের কথা।
পুরো উপন্যাসে আজাদের গল্প ছাড়াও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। আর রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যারা সব সময়ই ছিলেন সেই মা, বাবা, বন্ধু, আত্মীয়দের কথা। এমন সব সত্যি ঘটনা তরুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য জানাতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারে। উপন্যাসে গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ঢাকার আরবান গেরিলা হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, হ্যারিস, বাচ্চু, ফতেহ, উলফত, শাহাদত চৌধুরী, চুলু, আলভী, আসাদ, শহীদুল্লাহ খান বাদ, হিউবার্ট রোজারিওসহ অনেকেরই কথা যেমন যুক্ত আছে উপন্যাসে তেমনি আজাদের মায়ের মৃত্যুর খবরে সকল গেরিলারা যখন আবার একত্রিত হয়েছিলেন সে কথাও রয়েছে। আজাদের মা সাফিয়া বেগমকে কবর দেয়া হয় জুরাইন গোরস্তানে সেখানে গেরিলাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামও।
মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত এ উপন্যাস নাড়া দেবে তরুন পাঠকদের। এছাড়া যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানতে চান তাদের জন্যও অসাধারণ এক উপন্যাস ‘মা’। সশ্রদ্ধ সালাম সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের যারা নিজের সব কিছুই ত্যাগ করে গিয়েছিলেন দেশকে স্বাধীন করতে। সঙ্গে শ্রদ্ধা সেই সব মা’দের যারা নিজের বুকের ধনকেও দেশের জন্য পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।