প্রতিদিনের মতো ২৮ এপ্রিলের সকালটি হয়নি। ঘুম ভাঙ্গতেই নজর পড়ে খবরে। জানতে পারি ওপারে চলে গেছেন জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। থমকে গেলাম খবরটি দেখে! সারাদিন এক ধরনের মন খারাপের দোলাচালে ছিলাম। কত শত স্মৃতি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অনেক গুণের একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন জেআরসি (জামিলুর রেজা চৌধুরী) স্যার। একাধারে তিনি ছিলেন প্রকৌশলী ও শিক্ষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে গণিতকে জনপ্রিয় করার আন্দোলনে ২০০৩ সাল থেকেই গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অগ্রগামী হয়ে। অসম্ভব মেধাবী, এতো বড় মাপের মানুষ হয়েও ছিলেন অমায়িক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে প্রথম বিভাগে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করা প্রিয় জেআরসি স্যার গণিত অলিম্পিয়াডের স্বেচ্ছাসেবকদের নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যাথ অলিম্পিয়াড ভলান্টিয়ার্স’ যা সংক্ষেপে মুভার্স। দীর্ঘ সময় গণিত অলিম্পিয়াডে কাজ করার সুবাদে মুভার্স হিসেবেই গর্বিত বোধ করি সব সময়। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য স্যার পেয়েছেন একুশে পদক। গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও পরিবেশ, স্থাপত্যসহ নানা অঙ্গনে স্যারের ছিল সগৌরব পদচারণা।
সাংবাদিকতা আর গণিত অলিম্পিয়াডে কাজ করার সুবাদে লম্বা একটা সময় খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে স্যারের সঙ্গে। দেখা যেত বিভিন্ন সময় কোনো নিউজের জন্য কমেন্ট নিতে বা যে কোনো প্রয়োজনে স্যারের কাছে যেতাম বা ফোন করতাম। কখনো তিনি ফোন রিসিভ করতে না পারলে ক্ষুদেবার্তা পাঠাতেন। এমন দিন খুব কমই হয়েছে যে, স্যারকে ফোন করে বা ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে কোনো রিপ্লাই পাইনি। স্যার কারো সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললে সবকিছুই মনে রাখতে পারতেন। বিশেষ করে গণমাধ্যমে কারো সঙ্গে কথা বলে সে বিষয়ে কোনো সংবাদ বা লেখা প্রকাশিত হলে তিনি খুঁটিয়ে পড়তেন। এর মধ্যে তিনি যদি কিছু না বলে থাকেন সেটি প্রকাশিত হলেও বুঝতে পারতেন। তাই অনেকেই স্যারের ইন্টারভিউ নিতে কিছুটা ভয়ই পেতেন।
একবার সুযোগ পেয়ে সাহস করে আমিই গেলাম সে কাজটি করতে। প্রথমবার খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কারণ, স্যারের মুখ থেকে তথ্যপ্রযুক্তির গত বছরের নানা বিষয় নিয়ে ‘প্রথম আলো’র প্রজন্ম ডট কমে প্রতি বছর একটি বড় লেখা প্রকাশিত হতো। পাতার সম্পাদক পল্লব মোহাইমেন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে বিষয়ে লিখতে। মনে আছে, প্রথমবার আলাদাভাবে লিখেছিলাম এবং রেকর্ডও করেছিলাম। লেখা প্রকাশের পর স্যার ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন ‘ভালো হয়েছে’।
এরপর থেকে কয়েক বছর এ ধরনের লেখা ছাড়াও নানা বিষয়ে ইন্টারভিউ নিয়েছি স্যারের। ওই একবারের লেখায় স্যারের কতটুকু আস্থা অর্জন করতে পেরেছি জানি না, তবে একদিন ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান এসে ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীনের কাছে জানতে চাইলেন, হাছিব (আমার ডাক নাম) কই? সম্পাদক আমাকে খুঁজছেন জেনে দ্রুত যেতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘কি তোমাকে জামিল ভাই খোঁজে কেন?’ কিছুটা ভয় পেলেও পরে জানতে পারলাম, জামিল স্যারের সঙ্গে মতি ভাই একটা অনুষ্ঠানে একটা বইয়ের বিষয়ে আলাপ করছিলেন। সেটা শুনে স্যার বলেছিলেন, হাছিবকে পাঠিয়ে দিও! ছোট্ট এ জীবনে এতো বড় প্রাপ্তি মনে হয় আমার আর আসেনি।
একবার একটা কমেন্ট নিতে স্যারকে ফোন দেই। ফোনে না পেয়ে ভাবছিলাম কীভাবে যোগাযোগ করবো। এর মধ্যেই স্যারের ক্ষুদেবার্তা পেলাম। স্যার লিখেছিলেন, তিনি জাপানে একটা সেশনে। বের হয়ে হোটেলে গিয়ে ফোন করবেন। পরে ফোন করেছিলেন, আমার কাজটিও হয়েছিল। ভাবতে থাকলাম, এমন একজন মানুষ যিনি দেশের বাইরে কাজে গিয়েও আমার ফোনের রিপ্লাই শুধু দেনইনি বরং কাজের জন্য সময়ও দিয়েছেন।
ঢাকা নিয়ে আমার যা জানাশোনা তার বেশির ভাগই স্যারের কাছ থেকে। তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও ঢাকা নিয়ে স্যারের অনেকগুলো ইন্টারভিউ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তখন ঢাকার প্রাচীন নানা ঘটনা জানতে পেরেছিলাম। স্যারের পৈতৃক বাড়ি এলিফ্যান্ট রোডে। আমি বেশির ভাগ সময়েই স্যারের বাসায় যেতাম। একদিন স্যার জানালেন, এ বাড়ি যখন তৈরি হয় তখন এখান থেকেই ঢাকা কলেজ দেখা যেত! চারপাশে ছিল ধান খেত এবং এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় স্যারদের বাড়িই ছিল প্রথম বাড়ি। ২০১০ সালেও স্যারের বাড়িতে গেলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হতো। মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই বিশাল খোলা জায়গা। বাঁপাশে দুটি গাড়ির গ্যারেজ, আর এরপরেই দোতলা বাড়ি। এ বাড়িতে অনেকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সর্বশেষ স্যারের পরিবার সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। স্যার তখন নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যান। কয়েকবার বলেছিলেন নতুন বাসায় যেতে, কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
পড়াশোনা নিয়ে স্যার সবসময় কথা বলতেন এবং উৎসাহ দিতেন। যতবারই গিয়েছি পড়াশোনা বিষয়ে কোনো না কোনো কথা হয়েছেই। সর্বশেষ নিজে পিএইচডি করার শখের কথাটি স্যারকে বলতেই স্যার খুব খুশি হয়ে অনেকগুলো পরামর্শ দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা টপিক দিয়ে আরো পরামর্শের জন্য কোথায় এবং কার সঙ্গে যোগাযোগ করবো সেটিও বলে দিয়েছেন। বের হওয়ার সময় জানতে চাইলেন, নুহান কেমন আছে? অনেকটা অবাক হয়ে ‘ভালো আছে’ বলে বের হয়ে ভাবতে লাগলাম স্যার আমার একমাত্র ছেলের নামও মনে রেখেছেন।
ফেসবুকে নানা সময়ে আমার বিভিন্ন স্ট্যাটাসে স্যার কমেন্ট করতেন। এটা আমার জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি ছিল। এতো ব্যস্ততার মাঝেও নিজেই ই-মেইল চেক করা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নজর রাখতেন স্যার। প্রতিদিন সকালে একাধিক খবরের কাগজ পড়ে গাড়িতে করে অফিসে যাওয়ার পথে সুডোকু মেলাতেন।
পদ্মা সেতু’র আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান হিসেবে স্যার নানা সময়ে ব্যস্ত থাকতেন। যখনই স্যারের অফিসে যেতাম পুরো রুমটি দেখতাম। স্যারের নানা কাজের আলাদা আলাদা ফাইলগুলোতে সে বিষয়ের নাম দেখে ভাবতাম, কত কাজ করেন স্যার! একবার বড় বড় সেতু তৈরিতে মূল বাধা কী হয় এমন বিষয়ে জানতে চাইলে স্যার বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেদিনই ভালো করে বুঝতে পেরেছিলাম নদী শাসনের বিষয়টি।
স্যারের সুবাদে নানা কাজেরও সুযোগ হয়েছিল। একবার স্যার আমাকে পাঠালেন স্থপতিদের সংগঠনের একটা কাজে। সেদিনই প্রথম পরিচিত হয় স্থপতি মুবাশ্বের হোসেনের সঙ্গে। স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন শুনেই তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘ওহ! তাহলে তো আর চিন্তা নেই।’ আমার বুকটা ভরে উঠেছিল। সর্বশেষ ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওপেন ডেটা, ওপেন এক্সেস নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে স্যারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অসুস্থতার কারণে স্যার আসতে পারেননি তবে ক্ষুদেবার্তা আর ই-মেইলে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছিলেন। এতো বড় মাপের একজন মানুষ কতটা বিনয়ী হতে পারেন সেটি দেখিয়েছেন জেআরসি স্যার। আমি আমার খুব প্রিয় একজন মানুষকে হারালাম আর জাতি হারালো অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষকে। ওপারে ভালো থাকবেন স্যার।
** ২৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে রাইজিংবিডি ডট কমে প্রকাশিত