‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপটি চালু হয় ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল।‘পথে নামলেই পথ চেনা যায়’ স্লোগান নিয়ে এটি পথ চলতে থাকে। বর্তমান সদস্যসংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এ সংখ্যা। নিয়মিতভাবে ফেসবুকের ব্যবহারকারীরা এতে যোগ দিয়ে নিজেদের নানা উদ্যোগের কথা জানান। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএএন) এ গ্রুপটির উদ্যোক্তা।
যেভাবে শুরু
মূলত উদ্যোক্তাদের কোনো একটি মাধ্যমে সাহায্য করতেই ফেসবুকে চালু হয় এই গ্রুপ। গ্রুপের পরিচিতি অংশে লেখা রয়েছে, ‘কর্মসংস্থানের একটি বড় অধ্যায় হলো আত্মকর্মসংস্থান। যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা কেবল নিজের দায় নেন না, তাঁরা সমাজের বড় দায়ও কাঁধে নেন। যাঁরা নতুন ধারা গড়তে চান, তাঁদের জন্য এই গ্রুপ।’ নতুন উদ্যোক্তা তৈরির এই উদ্যোগের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। এ গ্রুপ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, এমন ৩১ উদ্যোক্তাকে ২৭ এপ্রিল দেওয়া হয় সম্মাননা।
বিডিওএসএনের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল উদ্যোক্তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। সাধারণত অনেকেই ভাবেন, উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রথমে কিছুদিন চাকরি করে অভিজ্ঞতা নিতে হয়।ধারণাটা ঠিক নয়। চাকরি করলে চাকরির অভিজ্ঞতা হয়, উদ্যোক্তা হওয়ার অভিজ্ঞতা হয় না, বললেন বিডিওএসএনের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। তিনি বলেন, এখানে নতুন উদ্যোক্তাদের যেমন পরামর্শ দেওয়া হয়, তেমনি উদ্যোক্তাদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনাও করা হয়।
রয়েছে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত
গ্রুপটি চালু হওয়ার পর ধীরে ধীরে যখন বাড়তে থাকে এর সদস্যসংখ্যা, তখনই প্রয়োজন পড়ে একটি নীতিমালার। তাই সবার সহযোগিতায় তৈরি হয় নীতিমালা, বললেন গ্রুপের প্রশাসক সাজ্জাত হোসেন। যিনি এ গ্রুপের সদস্য হবেন, তাঁকেই এ নীতিমালা মেনে চলতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া নতুনদের জন্য রয়েছে একটি ইশতেহার, যেখানে উদ্যোক্তা হতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি সৃজনশীলতা, পুঁজি ও প্রশিক্ষণ, সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে বিস্তারিত আলোচনা। রয়েছে গ্রুপের সদস্য ও প্রশাসকদের লেখা শতাধিক নোট ও ডক ফাইল।
নিজেদের কাজের পাশাপাশি গ্রুপে বিভিন্ন সফল উদ্যোক্তাও প্রশাসক হিসেবে নতুনদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। গ্রুপের অ্যাডমিন ডিক্যাস্টালিয়ার প্রকল্প ব্যবস্থাপক সাবিলা ইনুন বলেন, নতুন উদ্যোক্তাদের কাজে লাগবে এসব ফাইল কিংবা ডকুমেন্টসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে শিল্পোদ্যোক্তা হতে চাইলে কী করতে হবে, পেটেন্ট কী, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যকোষ ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপণন নির্দেশিকা, ই-কমার্স সাইটের কার্যক্রম, ট্যাবলেট ও ইলেকট্রনিকস পণ্য ব্যবসা, ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য নিরীক্ষা কার্যক্রম, ট্রেডমার্ক নীতিমালা, ডোমেইন ও হোস্টিং ব্যবসার বিভিন্ন দিক, কর ও ভ্যাট সেবার বিষয়ে আলোচনা এবং বিজনেস ম্যানুয়াল।
উদ্যোক্তাদের জন্য সাধারণ জানার বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তর বিভাগ, জেলাভিত্তিক উদ্যোক্তাদের তালিকাও আছে এতে। চাইলে গ্রুপের মাধ্যমেই একে অন্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে পারেন।ছবি তোলার ব্যবসা, কৃষি কার্যক্রম, অনলাইনে স্বয়ংক্রিয় মোবাইল রিচার্জের ব্যবস্থা, ফ্রিল্যান্সিং, অ্যানিমেশন, নেটওয়ার্কিং, নার্সারি, বায়িং হাউসসহ উদ্যোক্তা-সংক্রান্ত বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে এ গ্রুপে। রয়েছে পিডিএফ আকারেও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। শুধু আলোচনাই নয়, কেউ যদি কোনো কাজ সংক্রান্ত ফরম কিংবা প্রয়োজনীয় কী কী লাগবে সে সাহায্য চান, তা-ও খুব সহজেই করে দেন গ্রুপের সদস্যরা। এককথায় নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিংবা কাজে লাগবে, তার সবকিছুই এ গ্রুপে যুক্ত করা হয়েছে।
সফলদের কথা
‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের সদস্যরা শুধু আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকছেন না। সফল উদ্যোক্তা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন অনেকেই।গ্রুপের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা ডেভসটিমের প্রধান নির্বাহী আল-আমিন কবির বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান শুরুর ক্ষেত্রে এ গ্রুপের বেশ সহযোগিতা পেয়েছি এবং প্রতিষ্ঠান শুরুর ক্ষেত্রে এ গ্রুপই আমাদের অনুপ্রেরণা।’ বর্তমানে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং কাজের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। একই গ্রুপ থেকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন জোভোক্সের প্রধান নির্বাহী রাহাত হোসেন। ছয়জন সহযোগী নিয়ে কাজ করা জোভোক্স মূলত ওয়েবসাইট উন্নয়ন, গ্রাফিকস ডিজাইন, অ্যাপ্লিকেশন তৈরির পাশাপাশি ডিজিটাল বিপণন সেবা দেয়।
রাহাত বলেন, ‘গ্রুপ থেকে নানা ধরনের সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়ে দেশের জন্য ভালো কিছু করার জন্যই জোভোক্সের যাত্রা। আশা করছি, ভালো কিছু করতে পারব।’ বিভিন্ন ধরনের শখের যন্ত্রপাতি গ্রাহকদের হাতে পৌঁছানোর কাজ করছেন আমার গ্যাজেটের প্রধান নির্বাহী সাইফুল আহমেদ। তিনি বললেন, গ্রুপের একটি কর্মশালায় গিয়েই বিষয়টি মাথায় এল। তার পরই শুরু করা। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ বিক্রি করছেন তিনি, তা-ও পুরোপুরি ফেসবুকের মাধ্যমে। শিগগিরই নিজের একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কাজটি শুরু করবেন রাহাত। বাংলাদেশের ই-কমার্স সেবাকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতেও কাজ করতে আগ্রহী তিনি। শাড়ি তৈরি করে নিজের পরিবারের মধ্যেই দিতেন চট্টগ্রামের শারমিন রাবেয়া। গ্রুপে যুক্ত হয়ে ভাবলেন এই কাজকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবেন। আর দিলেনও তিনি।
চট্টগ্রামে রূপকথা জামদানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে শারমিনের। শুধু যে ব্যক্তি পর্যায়েই উদ্যোক্তা হয়েছেন অনেকেই, তা নয়; বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে গ্রুপে পরিচয়, তারপর একসঙ্গে উদ্যোক্তা হয়েছেন তানভীর মোহাম্মদ, নাঈম আশরাফী ও মিলকী মাহমুদ। গড়ে তুলেছেন ইনফ্লাক লিমিটেড নামের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তানভীর মোহাম্মদ বললেন, ‘শুধু বাংলাদেশের জন্য ক্লাউডভিত্তিক সফটওয়্যার তৈরি করছি, যা সহজে যেমন ব্যবহার করা যাবে, তেমনি খরচও অনেক কম পড়বে।’
এ তো গেল উদ্যোক্তাদের কথা। গ্রুপ থেকে উদ্যোক্তা হয়েছেন আর প্রথমবারের মতো উদ্যোক্তা সম্মাননা পেয়েছেন ওয়াও অনলাইন শপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালিদা রহমান। তিনি বললেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং করছি অনেক দিন ধরেই, তবে এবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বড় আকারে শুরু করে যাচ্ছি। পাশাপাশি ই-কমার্সের কার্যক্রমও চালিয়ে যাব।’ একই কথা জানালেন সম্মাননা পাওয়া গ্রুপের সদস্য কল সেন্টার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সফটকলের প্রধান নির্বাহী বিপ্লব ঘোষ। উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক পরিচর্যার ক্ষেত্রেও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন গ্রুপের সদস্য বেটারস্টোরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ আনওয়ার। তিনি নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি করেছেন বিজনেস ইনকিউবেশন সেন্টার, যেখানে গ্রুপের অনেক উদ্যোক্তা কাজ করতে পারবেন। তিনি বললেন, ‘প্রথম ব্যবসার শুরুতে ইনকিউবেশনের সুবিধা উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ প্রয়োজন।’
অন্যান্য আয়োজন
আলোচনা, সহায়তা কিংবা কর্মশালার পাশাপাশি ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপটি সহযোগী হিসেবে কাজ করছে নানা আয়োজনের সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের নিয়ে ১ থেকে ৩ মে চট্টগ্রামে গ্রুপের আয়োজনে শিশু একাডেমিতে চলছে ‘উদ্যোক্তা উৎসব’। আজ শেষ হবে এ উৎসব। এমন সব আয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছে ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপটি। যারা নাম দিয়েই বলে দিতে চায়, নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় সামনের দিকে।
** ০৩ মে ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত