"> একজন হরিপদ কাপালী – Nurunnaby Chowdhury

একজন হরিপদ কাপালী

বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। বর্তমানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে গেলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে আগের চেয়ে তিন গুণ। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের মাঠের কৃষকরা। আমাদের দেশের কৃষক-বিজ্ঞানীরা নিজেরাও উৎপাদনের পাশাপাশি দারুন কিছু উদ্ভাবনের কাজটিও করে চলেছেন একই সঙ্গে। শুধুই কী উদ্ভাবন? নিজের উদ্ভাবন আবার অন্য কৃষকদেরও দিয়ে দিচ্ছেন চাষ করার জন্য! আর সে উচ্চফলনশীল ধান চাষ করে হাসিমুখ এখন অনেক কৃষকের। এ কাজটি করে গেছেন কৃষিবিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী। একেবারে গ্রামীণ আবহে জন্ম, ছোট বয়সেই বাবা-মাকে হারানো, বিভিন্ন জনের ক্ষেতে কাজ করে তিনি উদ্ভাবন করেছেন ‘হরিধান’। উচ্চফলনশীল এ ধান ইতিমধ্যেই সারাদেশের কৃষকদের কাছে বেশ পরিচিত।

প্রায় দেড় দশক আগে হরিপদ কাপালী নিজের ধানক্ষেতে চাষ করতে গিয়ে একটি গোছা আবিষ্কার করেন যা অন্য ধানের গোছা থেকে ভিন্ন। আলাদা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন সে ছড়াতে ধানের সংখ্যা বেশি এবং গাছটিও বেশ পুরুষ্টু। একটু আলাদা বলেই সে গোছাটিকে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন হরিপদ কাপালী। আলাদা করেই গোছাটিকে লালন-পালন করে পরের বছর আলাদা জায়গায় ছোট করে বীজতলা তৈরি করলেন। চারাগুলো লাগালেন আরেকটি ছোট জায়গায়। ফলনের পর দেখা গেলো মোট জমিতে যে ধান হয়েছে তার ফল বিআর-১১ ধানের চেয়ে বেশি! বিষয়টি দেখে তিনি সে সময়ে অনেকের সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করেছিলেন কিন্তু বিষয়টি তেমন কেউ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু হরিপদ চিন্তা করে ঠিক করে নিলেন পরের বছর নিজের পুরো জমিতেই নতুন এ ধানটিই চাষ করবেন। নিজের সে ইচ্ছে অনুযায়ী সে কাজটিই করলেন তিনি এবং পরের বছর দেখা গেলো তার জমিতে নতুন ধানে বিআর-১১ কিংবা স্বর্ণার চেয়ে উচ্চফলনশীল ধান বেশি জন্মেছে। হিসেব করে দেখা গেলো, প্রতি বিঘাতে বিআর-১১ ধানের ফলন হয় ১৮ থেকে ২০ মণ কিন্তু নতুন ধানে একই বিঘাতে ফলন হয়েছে ২২ মণ! আর এ চাষ পদ্ধতিতে সারও লেগেছে কম।

শুরুতেই তেমন সাড়া না পেলেও ধানের ফলন বেশি হওয়ায় আশেপাশের কৃষক থেকে শুরু করে দূরদূরান্তের কৃষকদের মধ্যেও বেশ সাড়া পড়ে গেলো। যারা এসেছেন নতুন ধানের বীজটি নিতে তাদেরকেই বিনামূল্যেই মনের আনন্দে এ ধানের বীজ দিয়ে দিলেন হরিপদ কাপালী। শুধু দিয়েই ক্ষান্ত হননি অন্য যারা নিতে চায় তাদেরও দেওয়ার অনুরোধ জানালেন! যেখানে এখনও কিছু আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের পরেই আমাদের মাথায় চিন্তা চলে আসে কিভাবে সেটিকে ঘিরে ব্যবসা করা যায় সেখানে মাঠের সহজ সরল কৃষক হরিপদ নিজের উদ্ভাবন এমনিতেই বিতরণ করে দিলেন। ততদিনে সেই ‘হরির ধান’-এর নাম হয়ে গেলো ‘হরি ধান’। যারা হরিপদ কাপালীর কাছ থেকে ধানের বীজ নিয়েছিলেন তারাই মুখে মুখে সেই উচ্চফলনশীল ধানের নামকরণ করে দিলেন হরিপদ কাপালীর নামে। যে ‘হরি ধানে’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার আসাননগর গ্রামে সেটিই ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে।

প্রথমবার হরি ধানের কথা জানতে পারি পত্রিকায়। পরে আমার প্রিয় দুই বড় ভাই হরি ধানের পুরো বিষয়টি হরিপদ কাপালীর সাথে একদিন কাটিয়ে তুলে ধরেন বড় করে পত্রিকায়। তখন আরো ভালো ভাবে জানার সুযোগ হয়। পরে গণিত অলিম্পিয়াডে যুক্ত থাকার সুবাদে যখন হরিপদ কাপালীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তখন তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। একেবারে সহজ সরল একজন মানুষ। সে সময়েই আলোচনা শুরু হয় হরি ধান আসলে আলাদা কোনও জাত নয়, অনেকটাই বিআর-১১ বা স্বর্ণা ধানেরই একটু হেরফের! বিষয়টি জানার পরেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান এবং জীন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী’র নেতৃত্বে বিষয়টি গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর হরিধানের আণবিক বিশ্লেষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও আণবিক জীববিজ্ঞান বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সেবা ইসলাম সেরাজ। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষাগারে রোকাইয়া বেগমসহ একদল গবেষকের সহায়তায় জানা যায় হরি ধান নতুন একটি জাতের ধান। আর এ গবেষণার ফলাফলটি ছাপা হয় আন্তর্জাতিক জার্নালে।

হরিপদ কাপালীর এ উদ্ভাবন চমকে দিয়েছে অনেককে। পাশাপাশি নিজের উদ্ভাবনকে নিজের কাছে আটকে না রেখে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ কাজের জন্য তিনি তেমন বড় কোনও সরকারি স্বীকৃতি পাননি। তবে তার উদ্ভাবনই তাকে মনে রাখবে। তিনি বেঁচে থাকবেন কৃষকের মাঠে আর হরি ধানের মাঝে। হরিপদ কাপালীর মতো এমন মাঠের কৃষকদের অভিবাদন। কারণ, তাদের মাঠের সে কঠিন কাজের ফলেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ।

** ০৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে বাংলা ট্রিবিউন ডট কমে প্রকাশিত

Leave a Reply